Sunday, October 31, 2021

আগমনী - জসীম উদ্‌দীন---জলের লেখন

আজ তুমি আসিবে যে মেয়ে,
সেই ডোবা পুকুরের পানা পুকুরের, কলমীলতার
জাল দিয়ে ঘেরা পানি- সেই সে পানিতে নেয়ে।
মনে যদি হয় কলমী ফুলের কতকটা রঙ
লইও অধরে মেখে,
ঠোটেতে মাখিও আর একটুকু হাসি
লাল সাপলার ফোটা ফুলগুলি দেখে।

যদি মনে হয় সিক্ত বসনে একটু দাঁড়িও
ও অঙ্গ বেয়ে ঝরিবে সজল সোনা,
দোষ নিওনাক ডাহুকের ডাকে হয় যদি কিছু
ছোট ছোট গীতি বোনা।
দোষ দিওনাক হে লাজ-শোভনা! বক্ষে তোমার
যুগল কমল ফুল,
সিক্ত বসন শাসন না মানি
যদি উকি দেয় নিমেষে করিয়া ভুল;
যদি আকাশের সোনা সোনা রোদ
সেখানে ছড়ায়ে পড়ে,
তুমি খুব ভাল মেয়ে!
কোন অপরাধ রাখিও না অন্তরে।
রঙিন বসন আজ না পরিলে,
পদ্ম পাতার সবুজ শাড়ীটি
তোমারে মানায় ভাল।
শ্রী অঙ্গ হতে তারি ভাজে ভাজে হাসিবে খেলিবে
বিজলী লতার আলো।
সামনে দেখিবে ধান খেতগুলি,
অঙ্গ হইতে ছড়াইও কিছু সোনা,
ধান ছড়াগুলি নাচিয়া উঠিবে
বাতাসের দোলে হয়ে চঞ্চল মনা।

সাবধানে তুমি চলিও কন্যা!
সামনে রয়েছে মটরশুটির খেত;
পাতায় পাতায় রাঙা বউগুলি
ফুল হয়ে ওরা হেসে কুটি কুটি
স্বপ্নের ঘোরে কোন সে বধুর
পেয়ে যেন সঙ্কেত।

এখনো রাতের শিশিরের ফোটা শুকায়নি কারো গায়ে,
এখনো রাতের জড়িত জড়িমা লাগিয়া রয়েছে দুইটি আঁখির ছায়ে।
অতি সাবধানে চলিও কন্যা দুপায়ে সোনার
নূপুর যেন না বাজে;
এ মধু-স্বপন ভাঙিলে তাদের
কোথায় লুকাবে সে অপরাধের লাজে!

আরো সাবধান হইও কন্যা!
যদি কেউ ভুল ভরে,
সে ফুলের মাঝে তুমিও একটি
আর কোন কেহ লয় বা গননা করে।
আরো একটুকা এগিয়ে গেলেই সরষে খেতের পরে,
তোমারে আমার যত ভাল লাগে,
সে অনুরাগের হলুদ বসন
বিছাইয়া আছে দিক দিগন্ত ভরে।
ক্ষণেক সেখানে দাঁড়াও যদি বা
ভোমর ভোমরী ফুল হতে ফুলে ঘুরে,
যে কথা তোমারে বলিবার ভাষা খুঁজিয়া পাইনা,
সে সব তোমারে শোনাইবে সুরে সুরে।

মাঝে মাঝে সেথা উতল পবন ফুলের সুবাসে ঢুলে,
হেথায় সেথায় গড়ায়ে পড়িতে
বিলি দেবে সুখে তাদের মাথার চুলে।
মনে হবে তব, মাঠখানি যেন হেলিছে দুলিছে।
হলুদ স্বপন ভরে,
সাবধান হয়ো, সুগন্ধ বায়ে ছড়িয়ে যেয়ো না
আর কোন দেশ পরে।
যদি মনে লয় সেইখান হতে
কিছুটা হলুদ মাখিও তোমার গায়,
সারা মাঠখানি জীবন পাইবে
তোমার অঙ্গে জড়াইয়া আপনায়।
দুধারে অথই সরিষার বন
মাঝখান দিয়ে সরু বাঁকা পথখানি,
দোষ নিওনাক ফুলেরা তোমার
ধরিলে আঁচল টানি।
অতি সাবধানে ছাড়িও আঁচল,
যেন তাহাদের সুকোমল দলগুলি;
ভাঙিয়া না যায়, নিঠুর হয়োনা
যদি বা তাহার স্বগোত্র বলি
তোমরে বা ভাষে ভুলি।

আরো কিছু পথ চলিতে পাইবে কুসুম ফুলের খেত,
হলুদে লালেতে মেশামেশী যেন
মাঠের কবির অলিখিত সঙ্কেত।
যদি মনে লয় সেখানে হোছট
খাইও ইচ্ছা ভরে,
তোমার শাড়ীতে রঙ দিয়ে নিও,
কুসুম ফুলের খেতখানি তুমি
সারাটি অঙ্গে ধরে।

সামনে দেখিবে আম কাঁঠালের ছায়ায় শীতল
কৃষাণীর ছোট বাড়ি,
শাখায় শাখায় নানা পাখি ফেরে
সুনাম গাহিয়া তারি।
সেইখান দিয়ে চলিতে যদি বা
আমার মনের বাসনা হইয়া কুটুম পাখিরা,
তোমারে হেরিয়া কুটুম কটুম ডাকে,
খানিক থামিও, তুমি ও এমন সুন্দর মেয়ে!
কেমনে এড়াবে সেই ভালবাসাটাকে।
চোখ গেল বলি কোন পাখি যদি
কেঁদে ওঠে উভরায়,
দোষ নিওনাক, আমিও দৃষ্টি কবে হারায়েছি
ও রূপের ধূপছায়।
যেদিন তোমারে দেখিছি কন্যা!
আন কানো রূপ পশে না পরাণে আর,
আমার স্বর্গ মর্ত্ত্য বেড়িয়া তোমার বালিকা
কান্তির যেন স্নানশেষে বারিধার।
আরা কিছুদূর চলিলে হেরিবে
জাঙলা ভরিয়া কন্যা সাজানী সীমলতাগুলি
হইয়া নীলাম্বরী,
তোমার লাগিয়া অপেক্ষমাণ,
যদি কোনদিন অঙ্গে লওব পরি।
যেখানে কন্যা, খনেক দাঁড়িও!
কিবা রূপ মরি মরি!
দেহ রামধনু হতে বিছরিছে
উছলিত রুপ ছিরি।
সেখানে হয়ত কোন গেঁয়ো কবি সারিন্দা সুরে,
কাহিনীর কোন নায়ীকার রূপ দিয়ে,
তোমার নামটি বাজায়ে বাজায়ে নদী তীরে তীরে
ফেরে যদি তার আপন ব্যথারে নিয়ে;
কিছুটা তাহারে দিও প্রশ্রয়
ইচ্ছা হইলে তাহার কাহিনী জালে;
নিজেরে জড়ায়ে বাঁচিয়া রহিও
অনাগত কোন দূর ভবিষৎ কালে।

সব হবে -শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ভালোবাসা সবই খায়এঁটো পাতা, হেমন্তের খড়
রুগ্ন বাগানের কোণে পড়ে থাকা লতার শেকড়
সবই খায়, খায় না আমাকে
এবং হাঁ করে রোজ আমারই সন্মুখে বসে থাকে।
আমি একটু একটু করে তাকে অবসন্ন হাওয়া দিতে পারি
একটু এনে দিতে পারি আমরুলের পাতার প্রকৃতি
স্মৃতির কাঁথায় তার স্পর্শযিনি উপস্থিত নেই
এইসবদিতে পারি, এতে কি শ্রীমুখ ফেরাবে?
আমার ভিতরে কোনো গোলযোগ নেই, প্রেম নেই
অন্যমনস্কতা লেগে আমার ভিতরে হয়ে হয়ে নেই
কিছু বা পাথর, নেই ফুটোফাটা, ফেলে রাখা ধুলো
আমার ভিতরে আছে সর্বাঙ্গে রঙীন পথগুলো
এতে সবই হবে

Friday, October 9, 2015

কাশফুলের কাব্য - নির্মলেন্দু গুণ

ভেবেছিলাম প্রথম যেদিন ফুটবে তোমায় দেখব,
তোমার পুষ্প বনের গাঁথা মনের মত লেখব

তখন কালো কাজল মেঘ তো ব্যস্ত ছিল ছুটতে,
ভেবেছিলাম আরো 'দিন যাবে তোমার ফুটতে

সবে তো এই বর্ষা গেল শরত এলো মাত্র,
এরই মধ্যে শুভ্র কাশে ভরলো তোমার গাত্র

ক্ষেতের আলে নদীর কুলে পুকুরের ওই পাড়টায়,
হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে বাঁশ বনের ওই ধারটায়

আকাশ থাকে মুখ নামিয়ে মাটির দিকে নুয়ে,
দেখি ভোরের বাতাসে কাশ দুলছে মাটি ছুঁয়ে

কিন্তু কখন ফুটেছে তা কেউ পারে না বলতে,
সবাই শুধু থমকে দাঁড়ায় গাঁয়ের পথে চলতে

উচ্চ দোলা পাখির মত কাশ বনে এক কণ্বে,
তুলছে কাশের ময়ূর চূড়া কালো খোঁপার জন্যে

শরত রানী যেন কাশের বোরখা খানি খুলে,
কাশ বনের ওই আড়াল থেকে নাচছে দুলে দুলে

প্রথম কবে ফুটেছে কাশ সেই শুধুরা জানে,
তাইতো সেটা সবার আগে খোঁপায় বেঁধে আনে

ইচ্ছে করে ডেকে বলি, ওগো কাশের মেয়ে-
"
আজকে আমার চোখ জুড়ালো তোমার দেখা পেয়ে
তোমার হাতে বন্ধী আমার ভালবাসার কাশ
তাইতো আমি এই শরতে তোমার কৃতদাস"

ভালবাসা কাব্য শুনে কাশ ঝরেছে যেই
দেখি আমার শরত রানী কাশবনে আর নেই

Thursday, April 9, 2015

বৈশাখের নাগরদোলায় _রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

আঁকড়ে থেকো না কিছু।
যে যাবার তাকে যেতে দাও
______________যে ফেরার সেতো ফিরবেই-
কলমি লতার ফ্ল্যাটে ফিরে যাবে হলুদাভ হাঁস,

তুমি সভ্যতার নাগরদোলায়
___________________দাঁড়িয়ে চিৎকার করো:
বর্নময় ভালোবাসা তুমি খুলে যাও
নীল পিরামিড তুমি খুলে যাও তোমার দরোজা।

তুমি প‘ড়ে থাকো
সময়ের বুটে পেষা বাম হাত তুমি
জীনে জীনে র্জীন করো জীবনের জটিল যকৃত।

তোমার পেয়ালা উপচে পড়ুক সমকাল
এক টুকরো বরফ আর রাষ্ট্রনীতি
____________________ঔপনিবেশিক ভিত--

তোমার পেয়ালা উপচে পড়ুক ভালোবাসা,
ইটের নিসর্গে শুধু ঘাম, শুধু মেদ, প্রেম নেই,
অথবা অন্য কোনো নাম তার-
__________________অন্য কোন নাম?
কি নাম তোমার ভালোবাসা??

কবিতা: বৈশাখের নাগরদোলায়
_রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

(০৭ বৈশাখ ১৩৯৪ রাজাবাজার ঢাকা)

Thursday, March 5, 2015

পশ্চাতে হলুদ বাড়ি পঞ্চাশ লালবাগ --রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

এটা প্রস্থান নয়,বিচ্ছেদ নয়—শুধু এক শব্দহীন সবল অস্বীকার
পরিকল্পিত প্রত্যাখ্যান, এ কোনো অভিমান নয়...ব্যার্থতা নয়।
বিরহে কাতর হবে, কাতরতা বাড়াবে স্বাধীন স্বদেশ, জানতাম
আমার শূণ্য চেয়ারে হাত রেখে তাকাবে রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতিচিহ্ন বকুল এর দিকে,
প্রতিদিন ঘরে ফেরার পদশব্দ শুনতে চেয়ে অপেক্ষা সাজাবে ভেতরে,
জানতাম আমার না থাকা শরীর করতলে প্রদীপের মতো
জ্বলতে-জ্বলতে জ্বালাবে নদী, পাখি, ফুল, সংসারে সাজানো সবুজ—
তবু এ কোনো প্রস্থান নয়,এ কোনো বিচ্ছেদ নয়।
এখন যেখানে যতদুরে থাকি দ্যাখা না হওয়াই ভালো।
তোমার দেয়ালের পলেস্তারে ভেষে উঠুক যৌবন-হস্তা-শ্বাপদ
উঠোনে কৃষ্ণচূড়ায় মৌশুমি ফুলের উল্লাশে ঝ’রে যাক হলুদ মাটিতে
অথবা আরো কিছু নতুন বৃক্ষের ছায়ায় ধ্বনিময় হোক জীবন যাপন,
আরো কিছু হোক, আরো বেশি কিছু—পাওয়া বা পতন
তবু দ্যাখা না হওয়াই ভালো।
চ’লে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়—বিচ্ছেদ নয়,
চ’লে যাওয়া মানেই নয় বন্ধন ছিন্ন করা আদ্র রজনী।
চ’লে গেলে আমারো অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না থাকা জুড়ে।

Saturday, January 17, 2015

চাবি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো !

থুৎনি ‘পরে তিল তো তোমার আছে
এখন ? ও মন, নতুন দেশে যাবি ?
চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হলো ।

চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো–
লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা ?

অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু – ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা ?





কিছু মায়া রয়ে গেলো-শক্তি চট্টোপাধ্যায়

সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
শুধু এই
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই
ঘৃনা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনজাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু