Saturday, November 15, 2014

নকশী কাঁথার মাঠ – ১৪ - জসীম উদ্‌দীন---নকশী কাঁথার মাঠ

চৌদ্দ

উইড়া যায়রে হংস পক্ষি পইড়া রয়রে ছায়া ;
দেশের মানুষ দেশে যাইব—কে করিবে মায়া |
— মুর্শিদা গান

আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,
নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে |
মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি,
ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি!
নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি,
কোন্ সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি !

বাতাসের পায়ে বাজেনা আজিকে ঝল মল মল গান,
মাঠের ধূলায় পাক খেয়ে পড়ে কত যেন হয় ম্লান!
সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ পরে,
মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে!
মাঠে মাঠে কাঁদে কলমীর লতা, কাঁদে মটরের ফুল,
এই একা মাঠে কি করিয়া তারা রাখিবেগো জাতি-কুল |
লাঙল আজিকে হয়েছে পাগল, কঠিন মাটিরে চিরে,
বুকখানি তার নাড়িয়া নাড়িয়া ঢেলারে ভাঙিবে শিরে |
তবু এই-গাঁও রহিয়াছে চেয়ে, ওই-গাঁওটির পানে,
কতদিন তারা এমনি কাটাবে কেবা তাহা আজ জানে |
মধ্যে লুটায় দিগন্ত-জোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ ;
সারা বুক ভরি কি কথা সে লিখি, নীরবে করিছে পাঠ!
এমন নাম ত শুনিনি মাঠের? যদি লাগে কারো ধাঁধাঁ,
যারে তারে তুমি শুধাইয়া নিও, নাই কোন এর বাঁধা |

সকলেই জানে সেই কোন্ কালে রূপা বলে এক চাষী,
ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমেতে গলায় পড়িল ফাঁসি |
বিয়েও তাদের হয়েছিল ভাই, কিন্তু কপাল-লেখা,
খন্ডাবে কেবা? দারুণ দুঃখ ভালে এঁকে গেল রেখা |
রূপা একদিন ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দূর দেশে,
তারি আশা-পথে চাহিয়া চাহিয়া বউটি মরিল শেষে |
মরিবার কালে বলে গিয়েছিল — তাহার নক্সী-কাঁথা,
কবরের গায়ে মেলে দেয় যেন বিরহিণী তার মাতা!

বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে,
শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী বেদনার তালে তালে |
প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়,
রোগ পাণ্ডডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়!
শিয়রের কাছে পড়ে আছে তার কখানা রঙীন শাড়ী,
রাঙা মেঘ বেয়ে দিবসের রবি যেন চলে গেছে বাড়ি!

সারা গায় তার জড়ায়ে রয়েছে সেই নক্সী-কাঁথা,—
আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা |

কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,—
মহা-শূণ্যেতে উড়িয়াছে কেবা নক্সী-কাথাটি ধরে ;
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশীটি বাজায় করুণ সুরে,
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে |
সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী-কাঁথার মাঠ,
ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ |

শেষ

 কুহেলিকা - কাজী নজরুল ইসলাম---চক্রবাক

তোমরা আমায় দেখ্‌তে কি পাও আমার গানের নদী-পারে?
নিত্য কথায় কুহেলিকায় আড়াল করি আপনারে।
সবাই যখন মত্ত হেথায় পান ক’রে মোর সুরের সুরা
সব-চেয়ে মোর আপন যে জন স-ই কাঁদে গো তৃষ্ণাতুরা।
আমার বাদল-মেঘের জলে ভর্‌ল নদী সপ্ত পাথার,
ফটিক-জলের কণ্ঠে কাঁদে তৃপ্তি-হারা সেই হাহাকার!
হায় রে, চাঁদের জ্যোৎস্না-ধারায় তন্দ্রাহারা বিশ্ব-নিখিল,
কলঙ্ক তার নেয় না গো কেউ, রইল জু’ড়ে চাঁদেরি দিল!

গানের আড়াল - কাজী নজরুল ইসলাম---চক্রবাক

তোমার কন্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কন্ঠের গান --
এইটুকু শুধু রবে পরিচয় ? আর সব অবসান ?
অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়,
গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয় ?

হয়তো কেবলি গাহিয়াছি গান, হয়ত কহিনি কথা,
গানের বানী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা ?
হৃদয়ে কখন জাগিল জোয়ার, তাহারি প্রতিধ্বনি
কন্ঠের তটে উঠেছে আমার অহরহ রণরণি' --
উপকূলে ব'সে শুনেছ সে সুর, বোঝ নাই তার মানে ?
বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দু'ল হয়ে শুধু কানে ?

                                        হায় ভেবে নাহি পাই --
যে - চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই ।
সাগরের সেই ফুলে ফুলে কাদা কূলে কূলে নিশিদিন ?
সুরেরে আড়ালে মূর্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বীণ ?
আমার গানের মালার সুবাস ছুঁল না হৃদয়ে আসি' ?
আমার বুকের বাণী হল শুধু তব কন্ঠের ফাঁসি?

                                      বন্ধু গো যেয়ো ভুলে --
প্রভাতে যে হবে বাসি, সন্ধায় রেখো না সে ফুল তুলে !
উপবনে তব ফোটে যে গোলাপ -- প্রভাতেই তুমি জাগি'
জানি, তার কাছে যাও শুধু তার গন্ধ-সুষমা লাগি' ।

যে কাঁটা লতায় ফুটেছে সে-ফুল রক্তে ফাটিয়া পড়ি'
সারা জনমের ক্রন্দন যার ফুটিয়াছে শাখা ভরি'
দেখ নাই তারে ! -- মিলন মালার ফুল চাহিয়াছ তুমি,
তুমি খেলিয়াছ বাজাইয়া মোর বেদনার ঝুমঝুমি !

ভোল মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়, 
আমি শুধু তব কন্ঠের হার, হৃদয়ে কেহ নয় !
জানায়ো আমারে যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি--
কন্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি !

তোমারে পড়িছে মনে - কাজী নজরুল ইসলাম---চক্রবাক

তোমারে পড়িছে মনে 
      আজি নীপ-বালিকার ভীরু-শিহরণে,
      যুথিকার অশ্রুসিক্ত ছলছল মুখে
      কেতকী-বধূর অবগুন্ঠিত ও বুকে-
                  তোমারে পড়িছে মনে।
হয়তো তেমনি আজি দূর বাতায়নে
                  ঝিলিমিলি-তলে
ম্লান লুলিত অঞ্ছলে
         চাহিয়া বসিয়া আছ একা,
বারে বারে মুছে যায় আঁখি-জল-লেখা।
বারে বারে নিভে যায় শিয়রেরে বাতি,
তুমি জাগ, জাগে সাথে বরষার রাতি।

                           সিক্ত-পক্ষ পাখী
তোমার চাঁপার ডালে বসিয়া একাকী
হয়ত তেমনি করি, ডাকিছ সাথীরে,
তুমি চাহি' আছ শুধু দূর শৈল-শিরে ।।
       তোমার আঁখির ঘন নীলাঞ্জন ছায়া
       গগনে গগনে আজ ধরিয়াছে কায়া । ...

আজি হেথা রচি' নব নীপ-মালা--
স্মরণ পারের প্রিয়া, একান্তে নিরালা
             অকারণে !-জানি আমি জানি
তোমারে পাব না আমি। এই গান এই মালাখানি
রহিবে তাদেরি কন্ঠে- যাহাদেরে কভু
চাহি নাই, কুসুমে কাঁটার মত জড়ায়ে রহিল যারা তবু।
বহে আজি দিশাহারা শ্রাবণের অশান্ত পবন,
তারি মত ছুটে ফেরে দিকে দিকে উচাটন মন,
           খুঁজে যায় মোর গীত-সুর
কোথা কোন্‌ বাতায়নে বসি' তুমি বিরহ-বিধুর।
তোমার গগনে নেভে বারে বারে বিজলীর দীপ,
আমার অঙ্গনে হেথা বিকশিয়া ঝরে যায় নীপ।
           তোমার গগনে ঝরে ধারা অবিরল,
আমার নয়নে হেথা জল নাই, বুকে ব্যথা করে টলমল।

আমার বেদনা আজি রূপ ধরি' শত গীত-সুরে
নিখিল বিরহী-কন্ঠে--বিরহিণী--তব তরে ঝুরে!
            এ-পারে ও-পারে মোরা, নাই নাই কূল!
            তুমি দাও আঁখি-জল, আমি দেই ফুল!

পথচারী - কাজী নজরুল ইসলাম---চক্রবাক

কে জা
নে কোথায় চলিয়াছি ভাই মুসাফির পথচারি,
দু'ধারে দু'কুল দুঃখ-সুখের-মাঝে আমি স্রোত-বারি!
আপনার বেগে আপনি ছুটেছি জন্ম-শিখর হ'তে
বিরাম-বিহীন রাত্রি ও দিন পথ হ'তে আন পথে!
নিজ বাস হ'ল চির-পরবাস, জন্মের ক্ষন পরে
বাহিরিনি পথে গিরি-পর্বতে-ফিরি নাই আর ঘরে।
পলাতকা শিশু জন্মিয়াছিনু গিরি-কন্যার কোলে,
বুকে না ধরিতে চকিতে ত্বরিতে আসিলাম ছুটে চ'লে।

জননীরে ভুলি' যে-পথে পলায় মৃগ-শিশু বাঁশী শুনি',
যে পথে পলায় শশকেরা শুনি' ঝরনার ঝুনঝুনি,
পাখী উড়ে যায় ফেলিয়া কুলায় সীমাহীন নভোপানে,
সাগর ছাড়িয়া মেঘের শিশুরা পলায় আকাশ-যানে,-
সেই পথ ধরি' পলাইনু আমি! সেই হ'তে ছুটে চলি
গিরি দরী মাঠ পল্লীর বাট সজা বাঁকা শত গলি।

-কোন গ্রহ হ'তে ছিঁড়ি
উল্কার মত ছুতেছি বাহিয়া সৌর-লোকের সিঁড়ি!
আমি ছুটে যাই জানিনা কোথায়, ওরা মোর দুই তীরে
রচে নীড়, ভাবে উহাদেরি তীরে এসেছি পাহাড় চিরে।
উহাদের বদূ কলস ভরিয়া নিয়ে যায় মোর বারি,
আমার গহনে গাহন করিয়া বলে সন্তাপ-হারী!
ঊহারা দেখিল কেবলি আমার সলিলের শিতলতা,
দেখে নাই-জ্বলে কত চিতাগ্নি মোর কূলে কূলে কোথা!

-হায়, কত হতভাগী-
আমিই কি জানি- মরিল ডুবিয়া আমার পরশ মাগি'।
বাজিয়াছে মোর তটে-তটে জানি ঘটে-ঘটে কিঙ্কিণী,
জল-তরঙ্গে বেজেছে বধূর মধুর রিনিকি-ঝিনি।
বাজায়েছে বেণু রাখাল-বালক তীর-তরুতলে বসি'।
আমার সলিলে হেরিয়াছে মুখ দূর আকাশের শশী।
জানি সব জানি, ওরা ডাকে মোরে দু'তীরে বিছায়ে স্নেহ,
দীঘি হ'তে ডাকে পদ্মমুখীরা 'থির হও বাঁধি গেহ!'

আমি ব'য়ে যাই- ব'য়ে যাই আমি কুলু-কুলু-কুলু-কুলু
শুনি না- কোথায় মোরই তীরে হায় পুরনারী দেয় উলু!
সদাগর-জাদী মণি-মাণিক্যে বোঝাই করিয়া তরী
ভাসে মর জলে,-'ছল ছল' ব'লে আমি দূরে যাই সরি'।
আঁকড়িয়া ধ'রে দু'তীর বৃথাই জড়ায়ে তন্তুলতা,
ওরা দেখে নাই আবর্ত মর, মোর অন্তর-ব্যথা!

লুকাইয়া আসে গোপনে নিশীথে কূলে মোর অভাগিনী,
আমি বলি 'চল ছল ছল ছল ওরে বধূ তোরে চিনি!
কূল ছেড়ে আয় রে অভিসারিকা, মরণ-অকূলে ভাসি!'
মোর তীরে-তীরে আজো খুঁজে ফিরে তোরে ঘর-ছাড়া বাঁশী।
সে পড়ে ঝাঁপায়-জলে,
আমি পথে ধাই-সে কবে হারায় স্মৃতির বালুকা-তলে!

জানি না ক' হায় চলেছি কোথায় অজানা আকর্ষণে,
চ'লেছি যতই তত সে অথই বাজে জল খনে খনে।
সন্মুখ-টানে ধাই অবিরাম, নাই নাই অবসর,
ছুঁইতে হারাই-এই আছে নাই- এই ঘর এই পর!
ওরে চল চল ছল ছল কি হবে ফিরায়ে আঁখি?
তরি তীরে ডাকে চক্রবাকেরে তরি সে চক্রবাকী!

ওরা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যায় কূলের কুলায়-বাসী,
আঁচল ভরিয়া কুড়ায় আমার কাদায়-ছিটানো হাসি।
ওরা চ'লে এক্যায়, আমি জাগি হায় ল'ইয়ে চিতাগ্নি শব,
ব্যথা-আবর্ত মচড় খাইয়া বুকে করে কলরব!
ওরে বেনোজল, ছল ছল ছল ছুটে চল ছুটে চল!
হেথা কাদাজল পঙ্কিল তোরে করিতেছে অবিরল।
কোথা পাবি হেথা লোনা আঁখিজল, চল চল পথচারী!
করে প্রতীক্ষা তোর তরে লোনা সাত-সমুদ্র-বারি!

বর্ষা-বিদায় - কাজী নজরুল ইসলাম---চক্রবাক

ওগো বাদলের পরী!
যাবে কোন্ দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী!
ওগো ও ক্ষণিকায়, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজ তব?
পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন্ দেশ অভিনব?

তোমার কপোল-পরশ না পেয়ে পাণ্ডুর কেয়া-রেণু/
তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেনু।

কুমারী ভীরু-বেদনা-বিধূর প্রণয়-অশ্র“ সম।
ঝরিছে শিশির-সিক্ত সেফালী নিশি-ভোরে অনুপম।

ওগো ও কাজল মেয়ে,
উদাস আকাশ ছলছল চোখ তব মুখে আছে চেয়ে।
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।

ওগো জলের দেশের কন্যা। তব ও বিদায় পথে
কাননে কাননে কদম-কেশর ঝরিছে প্রভাত হ’তে।
তোমার আদরে মুকুলিতা হয়ে ঊঠিল যে বল্লরী
তরুর কণ্ঠ জড়াইয়া তারা কাঁদে নিশিদিন ভরি।’

‘বৌ-কথা-কও’ পাখি
উড়ে গেছে কোথা, বাতায়নে বৃথা বউ করে ডাকাডাকি।
চাঁপার গেলাস গিয়াছে ভাঙিয়া, পিয়াসী মধুপ এসে’
কাঁদিয়া কখন গিয়াছে উড়িয়া কমল-কুমদী দেশে।

তুমি চলে যাবে দূরে,
ভদরের নদী দুকূল ছাপায়ে কাঁদে ছলছল সুরে!

যাব যবে দূর হিম-গিরি শিল, ওগো বাদলের পরী
ব্যথা ক’রে বুক উঠিবে না কভু সেথা কাহারেও স্মরি?
সেথা নাই জল, কঠিন তুষার, নির্মম শুভ্রতা-
কে জানে কী ভাল বিধুর ব্যথা -- না মধুর পবিত্রতা!
সেথা মহিমার ঊর্ধ্বে শিখরে নাই তরলতা হাসি,
সেথা যাও তব মুখের পায়ের বরষা-নূপুর খুলি,
চলিতে চকিতে চমকি’ উঠ না, কবরী উঠে না দুলি।

সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্না তাপসিনী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধারায় তেমনি “ফটিক-জল”

বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি - কাজী নজরুল ইসলাম---চক্রবাক


বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী !
ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হ’য়ে এল বিদায়ের রাতি !
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি,
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি ------

অস্ত-আকাশ-অলিন্দে তার শীর্ণ-কপোল রাখি’
কাঁদিতেছে চাঁদ, “মুসাফির জাগো, নিশি আর নাই বাকী |
নিশীথিনী যার দূর বন-ছায় তন্দ্রায় ঢুলু ঢুল্ ,
ফিরে ফিরে চায়, দু’-হাতে জড়ায় আঁধারের এলোচুল !”

চমকিয়া জাগি, ললাটে আমার কাহার নিশাস লাগে ?
কে করে ব্যজন তপ্ত ললাটে, কে মোর শিয়রে জাগে ?
জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী
নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক-তরুর সারি !

তোমাদের আর আমার আঁখির পল্লব-কম্পনে
সারা রাত মোরা ক’য়েছি যে কথা, বন্ধু পড়িছে মনে !
জাগিয়া একাকী জ্বালা ক’রে আঁখি আসিত যখন জল,
তোমাদের পাতা মনে হ’তে যেন সুশীতল করতল !

আমার প্রিয়ার !---- তোমার শাখার পল্লব-মর্মর
মনে হ’ত যেন তারি কন্ঠের আবেদন সকাতর |
তোমার পাতায় দেখেছি তাহারি আঁখির কাজল-লেখা,
তোমার দেহেরই মতন দীঘল তাহার দেহের রেখা |

তব ঝির্-ঝির্ মির্-মির্ যেন তারি কুন্ঠিত বাণী,
তোমার শাখায় ঝুলানো তারির সাড়ির আঁচল খানি !
. -------তোমার পাখার হাওয়া
তারি অঙ্গুলি-পরশের মত নিবিড় আদর ছাওয়া !

ভাবিতে ভাবিতে ঢুলিয়া প’ড়েছি ঘুমের শ্রান্ত কোলে,
ঘুমায়ে স্বপন দেখেছি,----তোমারি সুনীল ঝালর দোলে
তেমনি আমার শিথানের পাশে | দেখেছি স্বপনে , তুমি
গোপনে আসিয়া গিয়াছ আমার তপ্ত ললাট চুমি’ !

হয়ত স্বপনে বাড়ায়েছি হাত লইতে পরশখানি,
বাতায়নে ঠেকি’ ফিরিয়া এসেছে লইয়াছি লাজে টানি’ |
বন্ধু, এখন রুদ্ধ করিতে হইবে সে বাতায়ন !
ডাকে পথ, হাঁকে যাত্রীরা, “কর বিদায়ের আয়োজন !”

--আজি বিদায়ের আগে
আমারে জানাতে তোমারে জানিতে কত কি যে সাধ জাগে !
মর্মের বাণী শুনি তব, শুধু মুখের ভাষায় কেন
জানিতে চায় ও বুকের ভাষারে লোভাতুর মন হেন !
জানি-----মুখে মুখে হবে না মোদের কোনোদিন জানাজানি,
বুকে বুকে শুধু বাজাইবে বীণা বেদনার বীণাপানি !

হয়ত তোমারে দেখিয়াছি, তুমি যাহা নও তাই ক’রে,
ক্ষতি কি তোমার, যদি গো আমার তাতেই হৃদয় ভরে ?
সুন্দর যদি করে গো তোমারে আমার আঁখির জল,
হারা-মোমতাজে ল’য়ে কারো প্রেম রচে যদি তাজ-ম’ল,
--বল তাহে কার ক্ষতি ?
তোমাকরে লইয়া সাজাব না ঘর , সৃজিব অমরাবতী !--------

হয়ত তোমার শাখায় কখনো বসেনি আসিয়া শাখী,
তোমার কুঞ্জে পত্রকুঞ্জে কোকিল ওঠেনি ডাকি’ |
শূন্যের পানে তুলিয়া ধরিয়া পল্লব-আবেদন
জেগেছে নিশীথে জাগে নি ক’ সাথে খুলি’ কেহ বাতায়ন |
--সব আগে আমি আসি’
তোমারে চাহিয়া জেগেছি নিশীথ, গিয়াছে গো ভালবাসি’ !
তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়-লেখা
এইটুকু হোক্ সান্ত্বনা মোর, হোক্ বা না হোক্ দেখা |-------

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না |
-- নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ !------

শুধাইতে নাই, তবুও শুধাই আজিকে যাবার আগে-----
ঐ পল্লব-জাফ্ রি খুলিয়া তুমিও কি অনুরাগে
দেখেছ আমারে ----দেখিয়াছি যবে আমি বাতায়ন খুলি’ ?
হাওয়ায় না মোর অনুরাগে তব পাতা উঠিয়াছে দুলি’ ?

তোমার পাতার হরিৎ আঁচলে চাঁদিনী ঘুমাবে যবে,
মূর্চ্ছিতা হবে সুখের আবেশ,----সে আলোর উত্সবে,
মনে কি পড়িবে এই ক্ষণিকের অতিথির কথা আর ?
তোমার নিশাস শূন্য এ ঘরে করিবে কি হাহাকার ?
চাঁদের আলোক বিস্বাদ কি গো লাগিবে সেদিন চোখে ?
খড়খড়ি খুলি’ চেয়ে রবে দূর অস্ত অলখ-লোকে ?
--অথবা এমনি করি’
দাঁড়ায়ে রহিবে আপন ধেয়ানে সারা দিনমান ভরি’ ?

মলিন মাটীর বন্ধনে বাঁধা হায় অসহায় তরু,
পদতলে ধূলি, ঊর্ধ্বে তোমার শূন্য গগন-মরু |
দিবসে পুড়িছ রৌদ্রের দাহে, নিশীথে ভিজিছ হিমে,
কাঁদিবারও নাই শকতি, মৃত্যু-আফিমে পড়িছ ঝিমে !
তোমার দুঃখ তোমারেই যদি, বন্ধু ব্যথা না হানে,
কি হবে রিক্ত চিত্ত ভরিয়া আমার ব্যথার দানে !

ভুল ক’রে কভু আসিলে স্মরণে অমনি তা যেয়ো ভুলি’
যদি ভুল ক’রে কখনো এ মোর বাতায়ন যায় খুলি’,
বন্ধ করিয়া দিও পুনঃ তায় !--- তোমার জাফ্ রি-ফাঁকে
খুঁজো না তাহারে গগন-আঁধারে----মাটিতে পেলে না যাকে !

১৪০০ সাল - কাজী নজরুল ইসলাম---চক্রবাক

[কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "আজি হতে শতবর্ষ পরে" পড়িয়া]

                  আজি হ’তে শত বর্ষ আগে!
কে কবি, স্মরণ তুমি ক’রেছিলে আমাদেরে শত আনুরাগে,
                                    আজি হ’তে শত বর্ষ আগে।

                  ধেয়ানী গো, রহস্য-দুলাল!
উতারি’ ঘোমটাখানি তোমার আঁখির আগে
                                    কবে এল সুদূর আড়াল?

আনাগত আমাদের দখিন-দূয়ারী
বাতায়ন খুলি তুমি, হে গোপন হে স্বপ্ন-চারী,
                                    এসেছিলে বসন্তের গন্ধবহ-সাথে,
শত বর্ষ পরে যেথা তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি রাতে।
নেহারিলে বেদনা-উজ্জ্বল আঁখি-নীরে,
আনমনা প্রজাপতি নীরব পাখায়
                                    উদাসীন, গেলে ধীরে ফিরে।

                  আজি মোরা শত বর্ষ পরে
যৌবন-বেদনা-রাঙা তোমার কবিতাখানি
                                    পড়িতেছি অনুরাগ-ভরে ।।
                  জড়িত জাগর ঘুমে শিথিল শয়নে
শুনিতেছি প্রিয়া মোর তোমার ইঙ্গিত গান সজল নয়নে।

                                                      আজো হায়
                                    বারে বারে খুলে যায়
                                                      দক্ষিণের রুদ্ধ বাতায়ন,
গুমরি গুমরি কাঁদে উচাটন বসন্ত-পবন
                                    মনে মনে বনে বনে পল্লব মর্মরে,
কবরীর অশ্রুজল বেশী-খসা ফুল-দল পড়ে ঝ’রে ঝ’রে!

                  ঝিরি ঝিরি কাঁপে কালো নয়ন-পল্লব,
মধুপের মুখ হতে কাড়িয়া মধুপী পিয়ে পরাগ আসব!
কপোতের চষ্ণুপুটে কপোতীর হারায় কূজন
পরিয়াছে বনবধূ যৌবন-আরক্তিম কিংশুক-বসন।
                  রহিয়া রহিয়া আজো ধরনীর হিয়া
                  সমীর উচ্ছ্বাস্ব যেন উঠে নিঃশ্বসিয়া!

  তোমা হ’তে শত বর্ষ পরে--
  তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি,
                                    হে কবীন্দ্র, অনুরাগ ভরে!
আজি এই মদালসা ফাগুন-নিশীথে
তোমার ইঙ্গিত জাগে তোমার সঙ্গীতে!
চতুরালি, ধরিয়াছি তোমার চাতুরী।
                                    করি' চুরি

আসিয়াছ আমাদের দুরন্ত যৌবনে,
কাব্য হ’য়ে, গান হ’য়ে, সিক্তকন্ঠে রঙ্গীলা স্বপনে।
আজিকার যত ফুল- বিহঙ্গের যত গান যত রক্ত-রাগ
তব অনুরাগ হ’তে হে চির-কিশোর কবি,
                                    আনিয়াছে ভাগ !
                  আজি নব-বসন্তের প্রভাত-বেলায়
গান হ’য়ে মাতিয়াছে আমাদের যৌবন-মেলায়।

আনন্দ দুলাল ওগো হে চির অমর।
তরুণ তরুণি মোরা জাগিতেছি আজ তব মাধবী বাসর।
যত গান গাহিয়াছ ফুল-ফোটা রাতে--
                      সবগুলি তার
                      একবার--তা’ পর আবার
প্রিয়া গাহে, আমি গাহি, আমি গাহি প্রিয়া গাহে সাথে।
                  গান-শেষে অর্ধরাতে স্বপনেতে শুনি
কাঁদে প্রিয়া, “ওগো কবি ওগো বন্ধু ওগো মোর গুণী--”
                                    স্বপ্ন যায় থামি',
দেখি, বন্ধু, আসিয়াছ প্রিয়ার নয়ন-পাতে অশ্রু হ’য়ে নামি'।
                  মনে লাগে, শত বর্ষ আগে
   তুমি জাগো--তব সাথে আরো কেহ জাগে
                                    দূরে কোন্ ঝিলিমিলি-তলে
                                                      লুলিত-অঞ্চলে।
তোমার ইঙ্গিতখানি সঙ্গীতের করুণ পাখায়
উড়ে যেতে যেতে সেই বাতায়নে ক্ষণিক তাকায়,
ছুঁয়ে যায় আখি-জল রেখা,
                                        নুয়ে যায় অলক-কুসুম,
তারপর যায় হারাইয়া,--তুমি একা বসিয়া নিঝ্‌ঝুম।
                  সে কাহার আঁখিনীর- শিশির লাগিয়া,
মুকুলিকা বাণী তব কোনটি বা ওঠে মঞ্জুরিয়া,
                  কোনটি বা তখনো গুঞ্জরি ফেরে মনে
                                    গোপনে স্বপনে।

                  সহসা খুলিয়া গেল দ্বার,
আজিকার বসন্ত প্রভাতখানি দাঁড়াল করিয়া নমস্কার।
শতবর্ষ আগেকার তোমারি সে বাসন্তিকা দূতি
                  আজি তব নবীনের জানায় আকুতি!...
হে কবি-শাহান-শাহ। তোমারে দেখিনি মোরা,
                                    সৃজিয়াছ যে তাজমহল-
শ্বেতচন্দনের ফোঁটা কালের কপালে ঝলমল--
                  বিস্ময়-বিমুগ্ধ মোরা তাই হেরি,
  যৌবনেরে অভিশাপি-- “কেন তুই শতবর্ষ করিলি রে দেরী?”
                                    হায়, মোরা আজ
মোম্‌তাজে দেখিনি, শুধু দেখিতেছি তাজ!

           শতবর্ষ পরে আজি হে কবি-সম্রাট!
এসেছে নূতন কবি--করিতেছে তব নান্দীপাঠ!
                  উদয়াস্ত জুড়ি' আজো তব
কত না বন্দনা-ঋক ধ্বনিছে নব নব।
                         তোমারি সে হারা-সুরখানি
নববেণু-কুঞ্জে-ছায়ে বিকশিয়া তোলে নব বাণী।

                                                      আজি তব বরে
                  শতবেণু-বীণা বাজে আমাদের ঘরে।
                               তবুও পুরে না হিয়া ভরে না ক' প্রাণ,
শতবর্ষ সাঁতরিয়া ভেসে আসে স্বপ্নে তব গান।
                                       মনে হয়, কবি ,
আজো আছ অস্তপাট আলো করি' আমাদেরি রবি!
                       আজি হ’তে শত বর্ষ আগে
যে অভিবাদন তুমি ক’রেছিলে নবীনেরে রাঙা অনুরাগে,
                  সে-অভিবাদনখানি আজি ফিরে চলে
                  প্রণামী-কমল হ’য়ে তব পদতলে!

মনে হয়, আসিয়াছ অপূর্ণের রূপে
                  ওগো পূর্ণ আমাদেরি মাঝে চুপে চুপে।
আজি এই অপূর্ণের কম্প্র কন্ঠস্বরে
তোমারি বসন্তগান গাহি তব বসন্ত-বাসরে--
                                    তোমা হ’তে শতবর্ষ পরে!

আমার কৈফিয়ৎ - কাজী নজরুল ইসলাম---সর্বহারা

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
   কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
     কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
     ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
   যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
   দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!

   কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
   বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
     পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
     কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
   কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
   কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!

   গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
   প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
     আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
     অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
   সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
   যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!

   মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
   ‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
     ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
     যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
   ‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
   হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’

   আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী।
   ‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
     ‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
     ‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’
   গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি!
   স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!

   নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
   ‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
     ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
     যুগের না হই, হজুগের কবি
   বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী,
   দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!

   কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
   হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
     বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
     রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
   যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
   শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?

   বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
   হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
     যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
     মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
   তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
   হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!

   আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে!
   প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে
     ‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
     বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
   গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
   নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।
   
   বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
   গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
     রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
     স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
   চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
   মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!
   
  ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
  বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
     কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
     স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
   কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
   কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?

   আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
   কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
     এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
     টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
   মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
   হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!
   
   বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
   দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
     রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
     তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
   বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
   অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
   
   পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
   মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
   প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
   যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!

কাণ্ডারী হুশিয়ার! - কাজী নজরুল ইসলাম---সর্বহারা


দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান!
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!

গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ
কান্ডারী! তুমি ভূলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
‘করে হানাহানি, তবু চল টানি’, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!

কৃষ্ণনগর; ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩

গোকুল নাগ - কাজী নজরুল ইসলাম---সর্বহারা

 না ফু
রাতে শরতের বিদায়-শেফালি,
   না নিবিতে আশ্বিনের কমল-দীপালি,
   তুমি শুনেছিলে বন্ধু পাতা-ঝরা গান
   ফুলে ফুলে হেমনে-র বিদায়-আহবান!
   অতন্দ্র নয়নে তব লেগেছিল চুম
   ঝর-ঝর কামিনীর, এল চোখে ঘুম
   রাত্রিময়ী রহস্যের; ছিন্ন শতদল
   হ’ল তব পথ-সাথী; হিমানী-সজল
   ছায়াপথ-বিথী দিয়া শেফালি দলিয়া
   এল তব মায়া বধূ ব্যথা-জাগানিয়া!
   এল অশ্রু হেমনে-র,এল ফুল-খসা
   শিশির-তিমির-রাত্রি; শ্রান- দীর্ঘশ্বাসা
   ঝাউ-শাখে সিক্ত বায়ু ছায়া-কুহেলির
   অশ্রু-ঘন মায়া-আঁখি, বিরহ-অথির
   বুকে তব ব্যথা-কীট পশিল সেদিন!
   যে-কান্না এল না চোখে, মর্মে হ’ল লীন,
   বক্ষে তাহা নিল বাসা, হ’ল রক্তে রাঙা
   আশাহীন ভালবাসা, ভাষা অশ্রু-ভাঙা!
   বন্ধু,  তব জীবনের কুমারী আশ্বিন
   পরিল বিধবা বেশ করে কোন্‌ দিন,
   কোন্‌ দিন সেঁউতির মালা হ’তে তার
   ঝ’রে গেল বৃন-গুলি রাঙা কামনার-
   জানি নাই; জানি নাই, তোমার জীবনে
   হাসিছে বি”েছদ-রাত্রি, অজানা গহনে
   এবে যাত্রা শুরু তব, হে পথ-উদাসী!
   কোন্‌ বনান-র হ’তে ঘর-ছাড়া বাঁশী
   ডাক দিল, তুমি জান। মোরা শুধু জানি
   তব পায়ে কেঁদেছিল সারা পথখানি!
   সেধেছিল, এঁকেছিল ধূলি-তুলি দিয়া
   তোমার পদাঙ্ক-স্মৃতি।

      রহিয়া রহিয়া
   কত কথা মনে পড়ে! আজ তুমি নাই,
   মোরা তব পায়ে-চলা পথে শুধু তাই
   এসেছি খুঁজিতে সেই তপ্ত পদ-রেখা,
   এইখানে আছে তব ইতিহাস লেখা।
   
   জানি না ক’ আজ তুমি কোন্‌ লোকে রহি’
   শুনিছ আমার গান হে কবি বিরহী!
   কোথা কোন্‌ জিজ্ঞাসার অসীম সাহারা,
   প্রতীক্ষার চির-রাত্রি, চন্দ্র, সুর্য, তারা,
   পারায়ে চলেছ একা অসীম বিরহে?
   তব পথ-সাথী যারা-পিছু ডাকি’ কহে,
   ‘ওগো বন্ধু শেফালির, শিশিরের প্রিয়!
   তব যাত্রা-পথে আজ নিও বন্ধু নিও
   আমাদের অশ্রু-আর্দ্র এ স্মরণখানি!’
   শুনিতে পাও কি তুমি, এ-পারে ও-পারে?
   এ কাহার শব্দ শুনি মনের বেতারে?
   কতদূরে আছ তুমি কোথা কোন্‌ বেশে?
   লোকান-রে, না সে এই হৃদয়েরি দেশে
   পারায়ে নয়ন-সীমা বাঁধিয়াছ বাসা?
   হৃদয়ে বসিয়া শোন হৃদয়ের ভাষা?
   হারায়নি এত সূর্য এত চন্দ্র তারা,
   যেথা হোক আছ বন্ধু, হওনি ক’ হারা!
   
   সেই পথ, সেই পথ-চলা গাঢ় স্মৃতি,
   সব আছে! নাই শুধু সেই নিতি নিতি
   নব নব ভালোবাসা প্রতি দরশনে,
   আরো প্রিয় ক’রে পাওয়া চির প্রিয়জনে-
   আদি নাই, অন- নাই, ক্লানি- তৃপ্তি নাই-
   যত পাই তত চাই-আরো আরো চাই,-
   সেই নেশা, সেই মধু নাড়ী-ছেঁড়া টান
   সেই কল্পলোকে নব নব অভিযান,-
   সব নিয়ে গেছ বন্ধু! সে কল-কল্লোল,
   সে হাসি-হিল্লোল নাই চিত-উতরোল!
   আজ সেই প্রাণ-ঠাসা একমুঠো ঘরে
   শূন্যের শূন্যতা রাজে, বুক নাহি ভরে!….
   হে নবীন, অফুরন- তব প্রাণ-ধারা।
   হয়ত এ মরু-পথে হয়নি ক’ হারা,
   হয়ত আবার তুমি নব পরিচয়ে
   দেবে ধরা; হবে ধন্য তব দান ল’য়ে
   কথা-সরস্বতী! তাহা ল’য়ে ব্যথা নয়,
   কত বাণী এল, গেল, কত হ’ল লয়,
   আবার আসিবে কত। শুধু মনে হয়
   তোমারে আমরা চাই, রক্তমাংসময়!
   আপনারে ক্ষয় করি’ যে অক্ষয় বাণী
   আনিলে আনন্দ-বীর, নিজে বীণাপাণি
   পাতি’ কর লবে তাহা, তবু যেন হায়,
   হৃদয়ের কোথা কোন্‌ ব্যথা থেকে যায়!
   কোথা যেন শূন্যতার নিঃশব্দ ক্রন্দন
   গুমরি’ গুমরি’ ফেরে, হু-হু করে মন!

     বাণী তব- তব দান- সে তা সকলের,
     ব্যথা সেথা নয় বন্ধু! যে ক্ষতি একের
     সেথায় সান-্বনা কোথা? সেথা শানি- নাই,
     মোরা হারায়েছি,- বন্ধু, সখা, প্রিয়, ভাই।…
     কবির আনন্দ-লোকে নাই দুঃখ-শোক,
     সে-লোকে বিরহে যারা তারা সুখী হোক!
     তুমি শিল্পী তুমি কবি দেখিয়াছে তারা,
     তারা পান করে নাই তব প্রাণ-ধারা!

   ‘ পথিকে’ দেখেছে তা’রা, দেখেনি ‘গোকুলে’,
   ডুবেনি ক’-সুখী তা রা-আজো তা’রা কূলে!
   আজো মোরা প্রাণা”ছন্ন, আমরা জানি না
   গোকুল সে শিল্পী গল্পী কবি ছিল কি-না!
   আত্মীয়ে স্মরিয়া কাঁদি, কাঁদি প্রিয় তরে
   গোকুলে পড়েছে মনে-তাই অশ্রু ঝরে!

     না ফুরাতে আশা ভাষা, না মিটিতে ক্ষুধা,
     না ফুরাতে ধরণীর মৃৎ-পাত্র-সুধা,
     না পূরিতে জীবনের সকল আস্বাদ-
     মধ্যাহ্নে আসিল দূত! যত তৃষ্ণা সাধ
     কাঁদিল আঁকড়ি’ ধরা, যেতে নাহি চায়!
     ছেড়ে যেতে যেন সব স্নায়ু ছিঁড়ে যায়!
     ধরার নাড়ীতে পড়ে টান! তরুলতা
     জল বায়ু মাটি সব কয় যেন কথা!
     যেয়ো না ক’  যেয়ো না ক’ যেন সব বলে-
     তাই এত আকর্ষণ এই জলে স’লে
     অনুভব করেছিলে প্রকৃতি-দুলাল!
     ছেড়ে যেতে ছিঁড়ে গেল বক্ষ, লালে লাল
     হ’ল ছিন্ন প্রাণ! বন্ধু, সেই রক্ত ব্যথা
     র’য়ে গেল আমাদের বুকে চেপে হেথা!

   হে তরুণ, হে অরুণ, হে শিল্পী সুন্দর,
   মধ্যাহ্ন আসিয়াছিলে সুমেরু-শিখর
   কৈলাসের কাছাকাছি দারুণ তৃষ্ণায়,
   পেলে দেখা সুন্দরের, স্বরগ-গঙ্গায়
   হয়ত মিটেছে তৃষ্ণা, হয়ত আবার
   ক্ষুধাতুর!-স্রোতে ভেসে এসেছে এ-পার
   অথবা হয়ত আজ হে ব্যথা-সাধক,
   অশ্রু-সরস্বতী কর্ণে তুমি কুরুবক!

     হে পথিক-বন্ধু মোর, হে প্রিয় আমার,
     যেখানে যে লোকে থাক/ করিও স্বীকার
     অশ্রু-রেবা-কূলে মোর স্মৃতি-তর্পণ,
    তোমারে অঞ্জলি করি’ করিনু অর্পণ!

  সুন্দরের তপস্যায় ধ্যানে আত্মহারা
  দারিদ্র্যে দর্প তেজ নিয়া এল যারা,
  যারা চির-সর্বহারা করি’ আত্মদান,
  যাহারা সৃজন করে, করে না নির্মাণ,
  সেই বাণীপুত্রদের আড়ম্বরহীন
  এ-সহজ আয়োজন এ-স্মরণ-দিন
  স্বীকার করিও কবি, যেমন স্বীকার
  ক’রেছিলে তাহাদের জীবনে তোমার!

    নহে এরা অভিনেতা, দেশ-নেতা নহে,
    এদের সৃজন-কুঞ্জ অভাবে, বিরহে,
    ইহাদের বিত্ত নাই, পুঁজি চিত্তদল,
    নাই বড় আয়োজন,নাই কোলাহল;
    আছে অশ্রু, আছে প্রীতি, আছে বক্ষ-ক্ষত,
    তাই নিয়ে সুখী হও, বন্ধু স্বর্গগত!
    গড়ে যারা, যারা করে প্রাসাদ নির্মাণ
    শিরোপা তাদের তরে, তাদের সম্মান।

  দু’দিনে ওদের গড়া প’ড়ে ভেঙে যায়
  কিন’ স্রষ্টা সম যারা গোপনে কোথায়
  সৃজন করিছে জাতি, সৃজিছে মানুষ
  অচেনা রহিল তা’রা। কথার ফানুস
  ফাঁপাইয়া যারা যত করে বাহাদুরী,
  তারা তত পাবে মালা যমের কস’রী!
  ‘আজ’টাই সত্য নয়, ক’টা দিন তাহা?
  ইতিহাস আছে, আছে অবিষ্যৎ, যাহা
  অনন- কালের তরে রচে সিংহাসন,
  সেখানে বসাবে তোমা বিশ্বজনগণ।
  আজ তারা নয় বন্ধু, হবে সে তখন,-
  পূজা নয়-আজ শুধু করিনু স্মরণ।

ছাত্রদলের গান - কাজী নজরুল ইসলাম---সর্বহারা

আমরা শক্তি আমরা বল
     আমরা ছাত্রদল।
  মোদের পায়ের তলায় মুর্সে তুফান
    উর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
     আমরা ছাত্রদল।।

  মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে
     যাত্রা নাঙ্গা পায়,
  আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই
     বিষম চলার ঘায়!
    যুগে-যুগে রক্তে মোদের
     সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল!  
     আমরা ছাত্রদল।।
  মোদরে কক্ষচ্যুত ধুমকেতু-প্রায়
     লক্ষহারা প্রাণ,
  আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর
     নিত্য বলিদান।
  যখন লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে ওঠেন,
    আমরা পশি নীল অতল,
     আমরা ছাত্রদল।।

  আমরা ধরি মৃত্যু-রাজার
     যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
    মোদের মৃত্যু লেখে মোদের
জীবন-ইতিহাস!
    হাসির দেশে আমরা আনি
     সর্বনাশী চোখের জল।
     আমরা ছাত্রদল।।

    সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়,
     আমরা করি ভুল।
    সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,
     আমরা ভাঙি কূল।
    দার”ণ-রাতে আমরা তর”ণ
     রক্তে করি পথ পিছল!
     আমরা ছাত্রদল।।

  মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল
     বক্ষে ভরা বাক্‌,
    কন্ঠে মোদের কুন্ঠ বিহীন
     নিত্য কালের ডাক।
  আমরা তাজা খুনে লাল ক’রেছি
     সরস্বতীর শ্বেত কমল।
     আমরা ছাত্রদল।।

       ঐ দারুণ উপপ্লাবের দিনে
     আমরা দানি শির,
    মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
     বিংশ শতাব্দীর!   
  মোরা গৌরবেরি কান্না দিয়ে
     ভ’রেছি মা’র শ্যাম আঁচল।
     আমরা ছাত্রদল।।

  আমরা রচি ভালোবাসার
   আশার ভবিষ্যৎ
মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়
   আকাশ-ছায়াপথ!
  মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
   স্বপ্ন দেখা হোক সফল।
   আমরা ছাত্রদল।।