সৈয়দ শামসুল হক



পরানের গহীর ভিতর ১১ 
সৈয়দ শামসুল হক
কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?
ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?
উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর
আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?
যখন তোমার দ্যাখা জানা নাই পাবো কি পাবো না,
যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম,
যথন ফুরায়া যাবে জীবনের নীল শাড়ি-বোনা
তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?
আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,
আমার বিছানে নাই সোহাগের তাতের চাদর,
আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বড় ফোক,
আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানী আতর।
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা।
 
একেই বুঝি মানুষ বলে 
সৈয়দ শামসুল হক
নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি

স্বাধীনতা দিবসঃ ২০০৭ 
সৈয়দ শামসুল হক

ধরা পড়ছে, ধরা পড়ছে আয়নাতে চেহারা।
ধরা পড়ছে এক্সরে প্লেটে স্বপ্নখাদক কারা।
ধরা পড়ছে, ধরা পড়ছে- হাতকড়াতে হাত।
চলছে মাকু, চলছে জোরে ইতিহাসের তাঁত
অনেক ছিলো নষ্টামি আর অনেকগুলো দিন-
তার ভেতরে ঘুরছে কালের কলের গানে পিন!
গানের অনেক রকম আছে- একাত্টরের গান!
স্বাধীনতার দিবস আসে, কে দেবে শ্লোগান?
মুখ খোলা তো বারণ, তাই কথা কোয়ো না কেউ।
শ্লোগান দেবে গাছের পাতা, নদীর জলে ঢেউ।
মানুষ আবার পলিমাটির দখল নেবে ফিরে।
মশাল জ্বেলে জাগছে ওরা আঁধার রাত্তিরে
আর কতটা দীর্ঘ হবে অমাবশ্যার রাত!
শক্ত হাতে চালাও জোরে ইতিহাসের তাঁত।
লাল সূর্যের ছবি ফোটাও বয়ন করা বস্ত্রে-
স্বাধীনতার মন্ত্রে এবং একাত্তরের অস্ত্রে
 
ভালোবাসার দিনে 
সৈয়দ শামসুল হক
রাতের অন্ধকার এখন আমার ছবি আকার ক্যানভাস
তোমার চোখের আলো আমার রঙ
একদিন তোমাকে যে ছঁয়েছি সেই আঙুল আমার তুলি এখন
আমি তো্মার ঘুমের ছবি আঁকছি
তুমি নিলীন হয়ে শুয়ে আছো এখন আমার ছবির ভেতরে।
এই ঘুম থেকে তোমাকে আমি জাগবো না
অস্থির পৃথিবী থেকে তুলে এনে ভালবাসার দুহাতে
তোমাকে এখন আমার স্থিরতার পটে স্থাপন করে ছলেছি
পৃথিবী্র সব রূপসীরা আমার পাশে দারিয়ে দেখছে তোমাকে,
আমি তাদের ঈর্ষা দিচ্ছি কেননা তারা স্থিরতা পায় নি
আমি একটু পরেই শুয়ে পড়বো তোমার পাশে -
তারপর একটু করে প্রান্তর ভরে উঠবে ঘাষে
কালের গ্রহণ লাগা চাঁদ তখন বেরিয়ে এসে
আমাদের দুজনেরই ছবি আঁকবে- যে দেখবে সে দেখবে

নোট বই থেকে 
সৈয়দ শামসুল হক
একদিন দুপুর-রোদ্দুরে তুমি নিয়ে এলে একখণ্ড নীল-
তোমার সূতির শাড়ি, সমুদ্রের সাথে যার অনিবার্য মিল;
আয়োজনে সে যেমন ঘিরে আছে পৃথিবীকে, শাড়িও তোমাকে
জীবনের বিপুল রহস্যগুলো সমুদ্রই চুরি করে রাখে

আরো একজন
 সৈয়দ শামসুল হক
যেখানেই যাও তুমি, যেখানেই যাও
সঙ্গে যায় আরো একজন;
যদিও অদূরে তবু তার দূরত্ব ভীষণ
যেখানেই দৃষ্টি দাও, যেখানেই দাও
দৃষ্টি দেয় আরো একজন;
যদিও সুনীল তবু সেখানেই মেঘের গড়ন
যাকেই যে কথা বলো, যাকেই যে কথা
শুনে যায় আরো একজন;
যদিও নিশ্চুপ তবু অবিরাম পদ্মার ভাঙন
যেখানেই রাখো হাত, যেখানেই রাখো
রাখে হাত আরো একজন;
যদিও নিশ্চল তবু দ্রুত তার শিরায় স্পন্দন
যখন শয্যায় তুমি, যখন শয্যায়
পাশে আছে আরো একজন;
যদিও ঘনিষ্ঠ তবু ঘুম কেড়ে নিয়েছে কখন
তুমি কি দেখেছো তাকে ? চেনো তাকে ?
সচকিত মাঝে মাঝে তাই ?
তোমার সম্মুখে তবে আমি এসে আবার দাঁড়াই ?

সে তো আমাদেরই 
সৈয়দ শামসুল হক
হঠাৎ কোন গ্রামে এসে গেলে তুমি!
কোথাও সড়ক নেই, শুধু জলাভূমি
যেন কেউ কেঁদে কেঁদে ঝরিয়েছে জলÑ
জলে তার চোখের কাজল
অথবা সে আকাশের নীলে
ছায়া ফেলে জলসঙ্গী ঝিলে
চলা থামেÑ এখানেই থামা পথিকের
যে হোক সে হোক সে তো আমাদেরইÑ
সে তো আমাদের

এখন মধ্যরাত 
সৈয়দ শামসুল হক
এখন মধ্যরাত।
তখন দুপুরে রাজপথে ছিলো মানুষের পদপাত।
মিছিলে মিছিলে টলমল ছিলো সারাদিন রাজধানী।
এখন কেবল জননকূল ছল বুড়িগঙ্গার পানি
শান্ত নীরব
নিদ্রিত সব।
ওই একজন জানালায় রাখে তার বিনিদ্র হাত
ছিলো একদিন তার
উজ্জ্বল দিন, ছিলো যৌবন ছিলো বহু চাইবার।
সারা রাত চষে ফিরেছে শহর খুঁজেছে সে ভালোবাসা।
পেতেছে সে হাত জীবনের কাছে ছিলো তারও প্রত্যাশা পাওয়া না পাওয়ার
প্রশ্নে হাওয়ার
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এখন সারারাত হাহাকার
পথে ওড়ে ধুলো, ছাই ওড়ে শুধু পথে যে আগুন ছিলো
একদা সে জ্বেলে ছিলো।
হৃদয়ে এখন সৌধের ভাঙা টুকরো আছাড় খায়।
আলো নিভে যায়, নিভে যায় আলো একে একে জানালায়।
থেমে যায় গান
তারপরও প্রাণ
বাঁশিটির মতো বেজে চলে যেন সবই আছে সবই ছিলো


No comments:

Post a Comment