Monday, November 3, 2014

নদীপথে – সোনার তরী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



গগন ঢাকা ঘন মেঘে ,
পবন বহে খর বেগে
অশনি ঝনঝন
ধ্বনিছে ঘন ঘন ,
নদীতে ঢেউ উঠে জেগে
পবন বহে খর বেগে
তীরেতে তরুরাজি দোলে
আকুল মর্মর-রোলে
চিকুর চিকিমিকে
চকিয়া দিকে দিকে
তিমির চিরি যায় চলে
তীরেতে তরুরাজি দোলে
ঝরিছে বাদলের ধারা
বিরাম-বিশ্রামহারা
বারেক থেমে আসে ,
দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে
আবার পাগলের পারা
ঝরিছে বাদলের ধারা
মেঘেতে পথরেখা লীন ,
প্রহর তাই গতিহীন
গগন-পানে চাই ,
জানিতে নাহি পাই
গেছে কি নাহি গেছে দিন ;
প্রহর তাই গতিহীন
তীরেতে বাঁধিয়াছি তরী ,
রয়েছি সারা দিন ধরি
এখনো পথ নাকি
অনেক আছে বাকি ,
আসিছে ঘোর বিভাবরী
তীরেতে বাঁধিয়াছি তরী
বসিয়া তরণীর কোণে
একেলা ভাবি মনে মনে
মেঝেতে শেজ পাতি
সে আজি জাগে রাতি ,
নিদ্রা নাহি দুনয়নে
বসিয়া ভাবি মনে মনে
মেঘের ডাক শুনে কাঁপে ,
হৃদয় দুই হাতে চাপে
আকাশ-পানে চায় ,
ভরসা নাহি পায় ,
তরাসে সারা নিশি যাপে ,
মেঘের ডাক শুনে কাঁপে
কভু বা বায়ুবেগভরে
দুয়ার ঝনঝনি পড়ে
প্রদীপ নিবে আসে ,
ছায়াটি কাঁপে ত্রাসে ,
নয়নে আঁখিজল ঝরে ,
বক্ষ কাঁপে থরথরে
চকিত আঁখি দুটি তার
মনে আসিছে বার বার
বাহিরে মহা ঝড় ,
বজ্র কড়মড় ,
আকাশ করে হাহাকার
মনে পড়িছে আঁখি তার
গগন ঢাকা ঘন মেঘে ,
পবন বহে খর বেগে
অশনি ঝনঝন
ধ্বনিছে ঘন ঘন ,
নদীতে ঢেউ উঠে জেগে
পবন বহে আজি বেগে
দুর্বোধ
তুমি মোরে পার না বুঝিতে ?
প্রশান্ত বিষাদভরে
দুটি আঁখি প্রশ্ন রে
অর্থ মোর চাহিছে খুঁজিতে ,
চন্দ্রমা যেমন ভাবে স্থিরনতমুখে
চেয়ে দেখে সমুদ্রের বুকে
কিছু আমি করি নি গোপন
যাহা আছে সব আছে
তোমার আঁখির কাছে
প্রসারিত অবারিত মন
দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা ,
তাই মোরে বুঝিতে পার না ?
যদি হইত শুধু মণি ,
শত খণ্ড করি তারে
সযত্নে বিবিধাকারে
একটি একটি করি গণি
একখানি সূত্রে গাঁথি একখানি হার
পরাতেম গলায় তোমার
যদি হইত শুধু ফুল ,
সুগোল সুন্দর ছোটো ,
উষালোকে ফোটো-ফোটো ,
বসন্তের পবনে দোদুল ,
বৃন্ত হতে সযতনে আনিতাম তুলে
পরায়ে দিতেম কালো চুলে
যে সখী , সমস্ত হৃদয়
কোথা জল , কোথা কূল ,
দিক হয়ে যায় ভুল ,
অন্তহীন রহস্যনিলয়
রাজ্যের আদি অন্ত নাহি জান রানী
তবু তোমার রাজধানী
কী তোমারে চাহি বুঝাইতে ?
গভীর হৃদয়-মাঝে
নাহি জানি কী যে বাজে
নিশিদিন নীরব সংগীতে
শব্দহীন স্তব্ধতায় ব্যাপিয়া গগন
রজনীর ধ্বনির মতন
যদি হইত শুধু সুখ ,
কেবল একটি হাসি
অধরের প্রান্তে আসি
আনন্দ করিত জাগরূক
মুহূর্তে বুঝিয়া নিতে হৃদয়বারতা ,
বলিতে হত না কোনো কথা
যদি হইত শুধু দুখ ,
দুটি বিন্দু অশ্রুজল
দুই চক্ষে ছলছল ,
বিষণ্ন অধর , ম্লান মুখ ,
প্রত্যক্ষ দেখিতে পেতে অন্তরের ব্যথা ,
নীরবে প্রকাশ হত কথা
যে সখী , হৃদয়ের প্রেম ,
সুখদুঃখবেদনার
আদি অন্ত নাহি যার
চিরদৈন্য চিরপূর্ণ হেম
নব নব ব্যাকুলতা জাগে দিবারাতে ,
তাই আমি না পারি বুঝাতে
নাই বা বুঝিলে তুমি মোরে!
চিরকাল চোখে চোখে
নূতন নূতনালোকে
পাঠ করো রাত্রি দিন ধরে
বুঝা যায় আধো প্রেম , আধখানা মন
সমস্ত কে বুঝেছে কখন ?

No comments:

Post a Comment